নেত্রকোণা প্রতিনিধি : নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলার রামজীবনপুর গ্রামের মাহাবুর আলম হত্যা মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজির আবেদন মঞ্জুর করেছে আদালত। ৪ আগস্ট মামলাটি বিচার বিভাগীয় পুনঃতদন্তের দিন ধার্য্য করেছেন আদালত।
এর আগে ৭ জুলাই মামলার তৃতীয় তদন্তকারী সংস্থা সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আইনজীবীর মাধ্যমে নারাজি দাখিল করেন মৃতক মাহবুর আলমের কন্যা মাহী আক্তার। কিন্তু ওইদিন নারাজি আবেদনকারী মাহী আক্তারের এইচএসসি পরিক্ষা থাকায় আদালতে উপস্থিত হতে না পারায় গত মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) ধার্য্যকৃত তারিখে নারাজি আবেদনকারী মাহী আক্তারের উপস্থিতিতে শুনানীর পর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, আমলী আদালতের বিচারক নুসরাতজাহান এ আদেশ দেন। এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো মামলাটির তদন্ত হতে যাচ্ছে।
এর আগে নেত্রকোণা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এই মামলা তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। মৃতকের কন্যা মাহীর দাবী তিন সংস্থার কেউই নিরপেক্ষ তদন্ত করেননি।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বারহাট্টা আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) আমজাদ হোসেন বলেন, মাহবুর আলম হত্যা মামলায় অপরাধ তদন্ত বিভাগের দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে মৃতকের কন্যা ১ নম্বর সাক্ষী মাহী আক্তারের নারাজি আবেদন মঞ্জুর করেছেন আদালত। এই হত্যা মামলাটি অধিকতর তদন্তের স্বার্থে আগামী সোমবার (৪ আগস্ট) বিজ্ঞ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, আমলী আদালতের বিচারক নুসরাতজাহান
সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন।
আদালত ও মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে নিজ শয়নঘরে খুন হয় মাহবুর আলম। ২৮ ফেব্রুয়ারি মৃতকের স্ত্রী স্বর্ণা আক্তার পুলিশের কাছে আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মাহাবুর হত্যাকান্ডে নিজের জড়িত থাকার বিষয়ে ১৬১ ধারায় স্বীকারোক্তি প্রদান করেন। ২৯ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক উম্মে সালমার আদালতে স্বর্ণা আক্তার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করেন। আদালতে দেওয়া স্বর্ণা আক্তারের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী অনুযায়ী জানা যায়, মৃতক মাহাবুর আলমকে হত্যাকান্ডের সময় আসামী স্বর্ণা আক্তার স্বামীর মুখে বালিশ চাপা দিয়ে রেখেছিলেন।
অজ্ঞাত আসামী পা জড়িয়ে ধরেছিলেন এবং একই গ্রামের আলেক চানের পুত্র সাজিদুর রহমান ওরফে নওয়াব আলী গামছা দিয়ে গলা পেচিয়ে শ^াসরোধ করে হত্যা করেছিলেন। এছাড়াও অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির হাতে থাকা কারেন্টের তার মৃতকের হাতের দুইটা আঙ্গুলে লাগিয়ে কারেন্টের লাইন দেয়। এ সময় মাহাবুর আলমের হাতের আঙ্গুল পুড়ে গন্ধ বের হয় এবং মৃত্যু নিশ্চিত করে কারেন্টের তার খুলে নিয়ে যায়। মৃতকের কন্যা মামলার ১ নম্বর সাক্ষী মাহী আক্তার জানান, ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী দিবাগত রাতে তার বাবা মাহবুর আলম নিজ শয়নঘরে খুন হন। একই মাসের ২৮ ফেব্রুয়ারী থানায় হত্যা মামলা হয়। ২৯ ফেব্রুয়ারী মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান বারহাট্টা থানার এসআই ফরিদ আহম্মেদ। পরবর্তীতে এসআই ফরিদ আহম্মেদ জেলা গোয়েন্দা কার্যালয়ে বদলী হয়ে আসলে অজ্ঞাত কারণে মামলাটিও জেলা গোয়েন্দা কার্যালয়ে বদলী হয়ে আসে এবং এসআই ফরিদ আহম্মেদ মামলাটি তদন্তভার গ্রহণ করেন। দীর্ঘদিন মামলার তদন্তে কোন অগ্রগতি না হওয়া এবং আসামীদের সাথে প্রকাশ্য সখ্যতার বিষয়ে তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জুয়েল আহম্মেদকে অবহিত করা হলে তাৎক্ষণিকভাবে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের
অফিসার ইনচার্জ খন্দকার সাকের আহমেদকে ডেকে তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন এবং দ্রুত আসামীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। ৭ নভেম্বর এসআই সাজ্জাদকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করেন। এরপর ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারী জেলা গোয়েন্দা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ খন্দকার সাকের আহমেদ নিজেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। একই বছরের ৩ মে তারিখে এসআই সোহাগ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। ১৭ সেপ্টম্বর এসআই উত্তম কুমার দাস মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। ২০২২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী এসআই নন্দন চন্দ্র সরকার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। ২২ ফেব্রুয়ারী আবারো এসআই ফরিদ আহম্মেদ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হন এবং মামলার এজাহারভুক্ত বা সন্দেহভাজন কোন আসামীকে আটক অথবা গ্রেফতার না করেই তদন্ত কাজ শেষ করে ২০২২ সালের ৮ মার্চ তিনি আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কর্তৃক আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করার পর বাদী সালেহা আক্তার দাখিলকৃত অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ২০ মার্চ নারাজি দাখিল করেন। বিজ্ঞ আদালত নারাজি মঞ্জুর করে পুলিশ ব্যুরো অব ইভেস্টিগেশন (পিবিআই) কে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। ২০২৩ সালের ৯ জানুয়ারি পিবিআই কর্তৃক বারহাট্টা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের মৃত মনির উদ্দিনের পুত্র মাঈন উদ্দিন ওরফে ভিকসানকে গ্রেফতার করে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করে ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। বিজ্ঞ আদালত রিমান্ড শুনানী শেষে ১ দিনের রিমান্ডে মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে আসামী মাঈন উদ্দিন ওরফে ভিকসান মামলা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেন বলে জানা যায়। ২০২৩ সালের ৮ মার্চ আসামী মাঈন উদ্দিন ওরফে ভিকসানকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইভেস্টিগেশন (পিবিআই) বিজ্ঞ আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
পুলিশ ব্যুরো অব ইভেস্টিগেশন (পিবিআই) বিজ্ঞ আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিলের পর বাদী সালেহা আক্তার দাখিলকৃত অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আবারোও নারাজি দাখিল করেন। নারাজি শুনানীর তারিখে অজ্ঞাত কারণে বাদী সালেহা আক্তার নারাজি প্রত্যাহারের আবেদন করেন। বাধ্য হয়ে ২০২৩ সালের ৮ নভেম্বর তারিখে আমার বাবা মাহবুর আলম হত্যা মামলার সুষ্টু তদন্ত ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে পুলিশ ব্যুরো অব ইভেস্টিগেশন (পিবিআই) কর্তৃক বিজ্ঞ আদালতে দাখিলকৃত সম্পূরক অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি দাখিল করি। বিজ্ঞ আদালত নারাজি শুনানী শেষে পুনরায় মামলার তদন্তভার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)কে অর্পন করেন।
মৃতকের কন্যা মাহী আক্তারের অভিযোগ আসামী স্বর্ণা আক্তারের ১৬৪ ধারায় আদালতে দেওয়া জবানবন্দি অনুয়ায়ী আসামী সাজিদুর রহমান ওরফে নওয়াব আলীকে গ্রেফতার না করে এবং অজ্ঞাতনামা আসামীর নাম পরিচয় সনাক্ত না করেই বার বার আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হচ্ছে। ফলে তারা ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে জানান। মাহাবুর আলম হত্যার প্রকৃত কারণ ও রহস্য উদঘাটন করে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানান। অন্যথায় দেশে অপরাধ প্রবনতা আরোও বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেন।