ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  আশ্বিন ১ ১৪৩১

ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন ও নতুন যুগ সূচনা করতে চাই : ড. ইউনূস

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:৫৪, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪  

ড. মুহাম্মদ ইউনূস

ড. মুহাম্মদ ইউনূস

তরুণ বিপ্লবীরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন জাগিয়ে দিয়েছে, তা পূরণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গণঅভ্যুত্থানে হতাহতদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন,  শহীদদের আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করতে চাই এবং এক নতুন যুগের সূচনা করতে চাই। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এখন বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, দুঃশাসন ও স্বৈরাচার দ্বারা সৃষ্ট ক্ষত পূরণ করা। এ জন্য প্রয়োজন একতা ও সমন্বয়।গতকাল বৃহস্পতিবার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক মাসপূর্তিতে দেওয়া বার্তায় এসব কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান। 

বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম মাস উদযাপন করছি উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, ইতিহাসের অন্যতম গৌরবময় বিপ্লবের জন্য শত শত ছাত্র এবং সর্বস্তরের মানুষ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে। অভিবাদন জানাই হাজার হাজার মানুষকেও, যারা আহত হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন কিংবা চক্ষু হারিয়েছেন।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ছাত্র-জনতা শেখ হাসিনার ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছে। তিনি একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র এবং একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি রেখে পালিয়েছেন। বাংলাদেশকে এর পূর্ণ গৌরবে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব আমাদের।

ড. ইউনূস বলেন, গত মাসে আমাকে যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তখন আবু সাঈদ, মুগ্ধ এবং জানা-অজানা শহীদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়ে সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ দায়িত্ব নিয়েছি।

তরুণরা বিপ্লবের নায়ক উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিপ্লবের সময় তোমরা পড়াশোনা ছেড়ে বন্ধুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন, ঘুমহীন রাত কাটিয়েছ এবং দিনে নিষ্ঠুর শাসনকে প্রতিহত করার জন্য পরস্পরের থেকে চিরবিদায় নিয়ে রাস্তায় নেমেছ। বিপ্লব শেষ হওয়ার পর তোমরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও তাদের উপাসনালয় পাহারা দিয়েছ এবং ট্রাফিক পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছ।
শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, জানি, তোমাদের পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হয়েছে। তাই এখন সময় পড়াশোনায় ফেরার। কেননা, বিপ্লবের সুফল ঘরে তুলতে সুশিক্ষিত ও দক্ষ প্রজন্মের দরকার।

বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জনের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, মাত্র এক মাস হলো অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। তা সত্ত্বেও বিপ্লবের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের কাজ শুরু করেছি। আমাদের প্রথম কাজ জুলাই ও আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। 
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই এবং আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক মানের ট্রাইব্যুনাল তৈরি করার প্রয়াসে শীর্ষ আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও কথা বলেছি। আমরা খুনিদের প্রত্যর্পণ এবং স্বৈরাচারের সময় আত্মসাৎ করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে চাই। এ জন্য বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ শুরু করেছি। 

তিনি বলেন, সরকারের প্রধান দায়িত্বগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিপ্লবের সময় গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হাজার হাজার মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করা। হাসিনার দুর্বৃত্তরা চোখ লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছোড়ায় অসংখ্য তরুণ শিক্ষার্থী দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করব তাদের চোখের আলো ফিরিয়ে দিতে।  শহীদ ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির জন্য ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছি। মূল তালিকা হয়ে গেছে। এখন শুধু দূর-দূরান্তে যাদের লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাদের তথ্য সংগ্রহ করে তথ্যগুলোর পূর্ণাঙ্গতা দেওয়া হচ্ছে। 

ড. ইউনূস বলেন, আহত শত শত মানুষ, যাদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন, তাদের ব্যয়বহুল চিকিৎসা এবং শহীদদের পরিবারের দেখাশোনার জন্য একটি ফাউন্ডেশন তৈরির শেষ পর্যায়ে আছে। যাদের শাহাদাতের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, আমরা তাদের কখনোই ভুলব না।

তিনি বলেন, আমরা স্বৈরাচার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘গুম সংস্কৃতি’র সমাপ্তি ঘটানোর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি। আলাদাভাবে আমরা ফ্যাসিবাদী শাসনের ১৫ বছরে গুমের প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করার জন্য কমিশন গঠন করছি। যেসব পরিবার তাদের নিখোঁজ বাবা, স্বামী, ছেলে এবং ভাইদের পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর ধরে যন্ত্রণার সঙ্গে অপেক্ষা করছে, আমরা সেই বেদনায় সমব্যথী।
আয়নাঘরগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, খুব শিগগির আমরা গুমের শিকার ভাইবোনের কষ্ট ও যন্ত্রণা সম্পর্কে জানতে পারব। 

গত মাসের শেষদিকে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, বিদেশি বন্ধুদের কাছ থেকে প্রচুর সমর্থন পেয়ে অভিভূত হয়েছি। সাহসী ও দেশপ্রেমিক প্রবাসীরাও জাতি পুনর্গঠন প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছেন। সরকারকে এভাবে সমর্থন করায় সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান বলেন, শহীদ পরিবারের সদস্যদের রাজধানীতে আমন্ত্রণ জানাব; কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের সঙ্গে দেখা করব। তাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আমরা কখনোই শহীদদের স্বপ্নের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না।
তিনি বলেন, সবাই প্রতিজ্ঞা নিলাম, শহীদদের রক্ত এবং আহত ভাইবোনের আত্মত্যাগকে জাতি হিসেবে আমরা কিছুতেই ব্যর্থ হতে দেব না। যে সুযোগ তারা আমাদের জন্য তৈরি করে দিয়েছেন, সে সুযোগকে কখনও হাতছাড়া হতে দেব না। আজ তাদের স্মৃতিময় দিনে আবারও প্রতিজ্ঞা করলাম, তাদের স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ আমরা গড়বই।

শিখা অনির্বাণে শ্রদ্ধা 
স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এদিন সকালে ঢাকা সেনানিবাসের শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন প্রধান উপদেষ্টা। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা পৌঁছালে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান ও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসান তাঁকে স্বাগত জানান। 

পুষ্পস্তবক অর্পণের পর ড. ইউনূস পরিদর্শন বইতে মন্তব্যসহ স্বাক্ষর করেন। পরে প্রধান উপদেষ্টা সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের কার্যালয়ে প্রথম কর্মদিবস পালন করেন। এর আগে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার এবং মহাপরিচালকরা। এর পর সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। 
এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়নবিষয়ক বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজ উপস্থিত ছিলেন।

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়