বন্ধ হচ্ছে না সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি, গতি বাড়ানোর নির্দেশ সরকারের

নিউজ ডেস্ক

সবার আগে সব খবর

প্রকাশিত : ১০:১৯ এএম, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ রোববার

বন্ধ হচ্ছে না সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি, গতি বাড়ানোর নির্দেশ সরকারের

বন্ধ হচ্ছে না সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি, গতি বাড়ানোর নির্দেশ সরকারের

কিছুটা স্থবির হয়ে পড়লেও বন্ধ হচ্ছে না বিগত সরকারের নেওয়া সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি। নানামুখী ত্রুটি ও আলোচনার পর এই কর্মসূচি বন্ধ করে দেওয়ার কোনও পরিকল্পনা নেই বর্তমান সরকারের। সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা যথারীতি চালু থাকবে, সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিক বৈঠকও হয়েছে।বর্তমান সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত, বিধিবদ্ধ সংস্থা ও সরকারি চাকরিজীবীদের এর আওতায় আনার ক্ষেত্রে যৌক্তিক ভিত্তিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে স্কিম চূড়ান্ত করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

চলতি বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে অনেকটাই তড়িঘড়ি করে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছিল শেখ হাসিনা সরকার। চলতি বছরের জুলাই ও আগস্টে দেশে অস্থিরতা দেখা দিলেও বন্ধ হয়নি সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির কার্যক্রম। এমন পরিস্থিতিতে অনেকের মনে সন্দেহ ছিল এটিকে বন্ধ করে দেওয়া হবে কি না? নানামুখী ত্রুটি নিয়ে এ কর্মসূচি চলবে কি না? এমন সন্দেহের প্রেক্ষিতে এই কর্মসূচিতে স্থবিরতা নেমে আসে। তবে সবার সন্দেহ দূর করে এই কর্মসূচিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছে বর্তমান সরকার।

শুধু তা-ই নয়, ভবিষ্যতে এ কর্মসূচিতে গতি ও জনগণের আস্থা বাড়াতে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম হাতে নেওয়ার কথা ভাবছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার ওপর প্রস্তুত করা কৌশলপত্র উপস্থাপন করেন। এরপর দ্রুত একটি আইন প্রণয়নের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন তিনি। নির্দেশের প্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ৩০ মার্চ সর্বজনীন পেনশন আইনের খসড়া প্রকাশিত হয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২২ সালের ৯ জুন ঘোষণা করেন যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হবে। ২০২৩ সালের ২৩ জুন সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে পেনশন চালু হওয়ার সঙ্গে মিল রেখে ওই বছরের ১৭ আগস্ট শেখ হাসিনা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা উদ্বোধন করেন।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য ছিল, দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা অবসরে গিয়ে এই পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন। শুধু তা-ই নয়, যারা বিদেশে কাজ করেন, সেসব প্রবাসীও এই কর্মসূচির আওতায় আসবেন। দেশের সাধারণ মানুষ, যাদের বয়স ১৮ বছর পূরণ হয়েছে তারা এবং তাঁতি, জেলে, কামার, কুমারসহ সব শ্রেণির মানুষ এই পেনশন-সুবিধা পাবেন।

বলা হয়েছে, দেশের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই সুবিধা পাবেন না। যারা সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করছেন, তারাও এ সুবিধার আওতায় আসবেন না। তবে তাদের কেউ যদি সর্বজনীন বেসকারি পেনশন-সুবিধা পেতে চান, তাহলে তাকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা ফেরত দিতে হবে। তারপর তিনি সর্বজনীন পেনশন-সুবিধা পাবেন।

শুরুতেই প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ‘প্রবাসী’, স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য ‘সুরক্ষা’, নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য ‘সমতা’ এবং বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের জন্য ‘প্রগতি’—এই চার স্কিম উন্মুক্ত করা হয়। উদ্বোধনের পর প্রথম এক মাসে চার স্কিমে গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ হাজার ৮৮৯ জন। এরপর কয়েক মাস গ্রাহক সংখ্যা কমলেও ষষ্ঠ মাস থেকে চাঁদাদাতার হার বাড়তে থাকে। চালুর আট মাস পর নিবন্ধন সম্পন্নকারীর সংখ্যা এক লাখের মাইলফলক স্পর্শ করে। এরপর চলতি বছরের মে ও জুনেও বিপুলসংখ্যক মানুষ নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা জমা দেন। এ দুই মাসে দুই লাখের বেশি মানুষ এ কর্মসূচিতে অংশ নেন। এতে গত ৮ জুলাই পর্যন্ত চার ধরনের পেনশন স্কিমে গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৫২ হাজারে।

তবে এর পরের ৪৯ দিনে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত এ কর্মসূচিতে নতুন গ্রাহক হয়েছেন মাত্র ১৯ হাজার ৯৫৯ জন। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এর গতি হারায়। ২৭ আগস্ট পর্যন্ত কর্মসূচিতে ৩ লাখ ৭১ হাজার ৯৬৯ জন গ্রাহক ১২০ কোটি ৩১ লাখ টাকার কিছু বেশি চাঁদা জমা দিয়েছেন।

এদিকে গত ১ জুলাই থেকে নতুন যুক্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত ও বিধিবদ্ধ সংস্থার চাকরিজীবীদের জন্য ‘প্রত্যয়’ স্কিম চালু করার সিদ্ধান্তের কথা জানায় অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক মাসের বেশি সময় আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এটি বাতিল করতে বাধ্য হয় বিগত সরকার।

এদিকে সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রম জোরদার ও পেনশন কর্তৃপক্ষের প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা নির্ধারণ করতে একটি প্রকল্প হাতে নেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। ‘সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক এই প্রকল্পের আওতায় সার্বিকভাবে এ কর্মসূচিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করারও উদ্যোগ গ্রহণ করে।

প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয় ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৮ সালের জুন পর্যন্ত। ব্যয় হবে ৩২ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, স্থানীয় মুদ্রায় যা ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এডিবির ঋণ হবে ২৫ কোটি ডলার এবং ৭ কোটি ৫০ লাখ ডলারের তহবিল জোগাবে সরকার। এ প্রকল্প জরুরি ভিত্তিতে নীতিগত অনুমোদনের জন্য গত ২৩ জুন পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় অর্থ মন্ত্রণালয়। বর্তমানে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির যে অবস্থা, তাতে এ প্রকল্প আপাতত হচ্ছে না।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটির অনুমোদন না দিয়ে বৈদেশিক অর্থায়ননির্ভর হওয়া প্রকল্পকে পাইপলাইনে রাখা হয়। বৈদেশিক ঋণের চাপ কমাতে পাইপলাইনের এসব প্রকল্প যথাযথভাবে পর্যালোচনার পর সিদ্ধান্ত হবে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।

আগামী বছরের ১ জুলাই থেকে সব ধরনের সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়া নতুন চাকরিজীবীদের এ কর্মসূচির আওতায় পেনশন দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেও, পরে পিছিয়ে এসেছে সরকার। এসব বিষয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা জানিয়েছেন, সরকার পরিবর্তন হলে এটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে, সাধারণ মানুষের মনে এ ধরনের শঙ্কা থাকলেও আমি মনে করি না। কারণ, এটি আইনের আওতায় প্রতিষ্ঠিত সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান।

অপরদিকে ভবিষ্যতে এ কর্মসূচিতে গতি আনতে জনগণের আস্থা বাড়াতে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম হাতে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি নিয়ে কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে এ নির্দেশনা দেন অর্থ উপদেষ্টা।

এ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, এ কর্মসূচি স্বাভাবিক নিয়মেই চলমান থাকবে।