২ মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয়

নিউজ ডেস্ক

সবার আগে সব খবর

প্রকাশিত : ১১:৪১ এএম, ২৯ আগস্ট ২০২৪ বৃহস্পতিবার

২ মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয়

২ মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয়

নতুন বাংলাদেশ গঠনে অর্থ পাচার প্রতিরোধে টাস্কফোর্স গঠনসহ ৫৫ সুপারিশ দিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সেখানে আছে দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। পাশাপাশি একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান এবং সংসদনেতা থাকতে পারবেন না। গতকাল বুধবার রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে সংস্থাটির নিজস্ব কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। ‘নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি প্রতিরোধ, গণতন্ত্র ও সুশাসন’ শীর্ষক লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। এ সময় টিআইবির উপদেষ্টা ড. সুমাইয়া খায়েরসহ অন্য কর্মকর্তরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া উল্লেখযোগ্য অন্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক খাতে ঋণ জালিয়াতি, সব ধরনের প্রতারণা এবং অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক-কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আর এ খাতের সমস্যা সমাধানে স্বাধীন ব্যাংক কমিশন গঠন করতে হবে। বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ বাতিল করতে হবে। জাতীয় সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। আরও আছে, নির্বাচিত সংসদ-সদস্যসহ জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে গণ-অনাস্থা প্রকাশের মাধ্যমে অপসারণ এবং ওই এলাকায় নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।

লিখিত বক্তব্যে ড. ইফতেখারুজ্জামান সুপারিশ দিয়ে বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলনিরপেক্ষ করতে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্বকারী গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে এর আগে আনা সব সংশোধনী বাতিল করতে হবে। একই ব্যক্তি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদনেতা থাকতে পারবেন না। এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে থাকতে পারবেন না। সংসদীয় স্থায়ী কমিটি শক্তিশালী করে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চত করতে হবে। বিশেষ করে সরকারি হিসাব; আইন, বিচার ও সংসদ; অর্থ; বাণিজ্য; স্বরাষ্ট্র; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে অন্তত ৫০ শতাংশ বিরোধীদলীয় সংসদ-সদস্যদের মধ্য থেকে সভাপতি নির্বাচন করতে হবে। গণতান্ত্রিক চর্চায় টিআইবির সুপারিশের মধ্যে আরও রয়েছে স্পিকারকে সংসদের অভিভাবক হিসাবে দলীয় প্রভাবমুক্ত থেকে ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব পরিহার করে সংসদের সব কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সংসদে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত করতে হবে বিরোধীদল থেকে। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের অবর্তমানে সভাপতিমণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত বিরোধীদলীয় সদস্যদের স্পিকার হিসাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দিতে হবে। আরও আছে-রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারে অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহতা নিশ্চিতে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে নিজ দলের ওপর অনাস্থা প্রস্তাব ও বাজেট ছাড়া আইন প্রণয়নসহ অন্য সব ক্ষেত্রে সংসদ-সদস্যদের নিজ দলের সমালোচনা এবং দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ সাপেক্ষে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা আইন প্রণয়ন করতে হবে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে বিচারপতি অপসারণের এখতিয়ার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপন ন্যস্ত করতে হবে। সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে ঢেলে সাজাতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য পুলিশের বাইরে একটি স্বাধীন কর্তৃপক্ষ গঠন করা প্রয়োজন। সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ এবং সরকারি কর্মচারী (আচরণবিধি) ১৯৭৯ হালনাগাদ করতে হবে। আরও বলা হয়েছে, বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করা জরুরি। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের ফৌজদারি আইনে গ্রেফতারে সরকারের অনুমতির বিধান বাতিল করতে হবে। সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে সংস্কার করতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কার্যক্রমের ওপর গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপ ও নজরদারি বন্ধ করতে হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য পরিবেশনে বাধা সৃষ্টিকারী ধারা আইন থেকে বাতিল করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের জন্য দলীয় প্রধানের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও পরিবারতন্ত্র বিলোপ করতে হবে। এছাড়া সব পর্যায়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দলের নেতৃত্ব নির্ধারণ, দলের আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা এবং নৈতিক স্খলনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দলের কোনো পদে না রাখা ও নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দেওয়া যাবে না।

টিআইবি বলেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনসহ বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘন, অনিয়ম-দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধ ও অর্থ পাচার রোধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় প্রভাবমুক্ত ও পেশাগত দক্ষতার উন্নয়ন করতে হবে।

সুপারিশে আরও বলা হয়, যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়েছে, সেসব দেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পারস্পরিক আইনি সহায়তা কার্যকর করতে হবে। আমদানি-রপ্তানি, হুন্ডি, আর্থিক খাতে জালিয়াতি ও বেনামি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সব ধরনের অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। দেশে-বিদেশে সব আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ‘দ্য কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (সিআরএস)’-এর মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের তথ্যপ্রাপ্তির সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। ব্যক্তি খাতের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা স্বচ্ছতা নিশ্চিতে এবং খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচার রোধে ‘মালিকানার স্বচ্ছতা আইন’ প্রণয়ন করতে হবে। আরও বলা হয়েছে, সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩-এর যেসব ধারা মানবাধিকারবিরোধী, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর প্ল্যাটফরমে অভিগম্যতায় অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সেগুলো সংশোধন বা বাতিল করতে হবে।

বিচার বিভাগে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ ক্ষমতায়িত নিজস্ব সচিবালয় স্থাপন ও কার্যকর করার সুপারিশ রয়েছে। এর পাশাপাশি উচ্চ ও অধস্তন আদালতে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলিসহ সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান সুপ্রিমকোর্টের কর্তৃত্বাধীন সচিবালয়ের ওপর ন্যস্ত করা, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে বিচারপতি অপসারণের এখতিয়ার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত করাসহ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বন্ধ করা প্রয়োজন। এছাড়া বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন ২০১৬-এর ধারা ১৪ এবং ‘আয়কর আইন ২০২৩’-এর ধারা ২ (৩১চ) বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। এর কারণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এ ধারাগুলো বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বিশেষ করে মানবাধিকার ও সুশাসন নিয়ে কাজ করে-এমন সংস্থার কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করে। আরও আছে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩’ বাতিল করা। টিআইবির প্রস্তাবে ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে খসড়া ‘ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা আইন’-এ প্রস্তাবিত বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানকে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসাবে গঠন করতে হবে। বহুমুখী মানবাধিকার হরণের হাতিয়ার ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) বিলুপ্ত করতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এসব সংস্কার করতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে কতটা লাগবে, তা নির্ধারণ করবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কেননা এ সরকার জনগণের ম্যান্ডেড নিয়ে এসেছে। তারা সংস্কার করতে যতটা সময়ের প্রয়োজন, ততটাই নেবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প মানেই দুর্নীতির মাধ্যমে একশ্রেণির মানুষের সম্পদ আহরণের মাধ্যম। এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জনগণের প্রয়োজনে প্রকল্প নিতে হবে।